মঙ্গলবার , ০১ জুলাই ২০২৫
Tuesday , 01 July 2025
০৫ মুহররম ১৪৪৭

হরমুজ আলী

প্রকাশিত: ১৭:৫৪, ২৬ জুন ২০২৫

প্রশ্নটা যতো সাদাসিধাই মনে হউক, উত্তরটা কিন্তু অতো সাদাসিধা না!

প্রশ্নটা যতো সাদাসিধাই মনে হউক,  উত্তরটা কিন্তু অতো সাদাসিধা না!

প্রশ্নটা যতো সাদাসিধাই মনে হউক, 
উত্তরটা কিন্তু অতো সাদাসিধা না!

ইদানিং একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রায়শই! প্রশ্নকারীর মধ্যে সহযোদ্ধা, বন্ধু, সুহৃদ, দলীয় সমর্থক থেকে তথাকথিত নির্দলীয়রাও আছেন। প্রশ্নটা হচ্ছে - আওয়ামী লীগ এখন কী করবে! যতো সাদাসিধাই মনে হউক না কেনো, উত্তরটা কিন্তু অতো সাদাসিধা না।

প্রথমেই বুঝে নেয়া দরকার - আওয়ামী লীগ কোন প্রেক্ষাপটে, কী প্রয়োজনে এবং কোন অঙ্গীকার নিয়ে জন্ম নিয়েছিল! মোটাদাগে উত্তর বোধহয় এরকম - যে আকাঙ্ক্ষা থেকে বাঙালিরা পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, '৪৭ এর তথাকথিত স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যেই তারা জেনে যায় যে এটা এক উপনিবেশের জায়গায় আরেক উপনিবেশের দখল। ভারতবর্ষ ভাগ করার পিছনে যে ধর্মীয় উন্মাদনা (উভয় পক্ষে) ছিলো, সেটাও উবে যেতে সময় লাগেনি, অন্তত পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্ষেত্রে। সুতরাং, নিজেদের (বাঙালিদের) জন্য স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের একটা যৌক্তিক দাবি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম। সময়ের পরিক্রমায় স্বাধিকার আর সায়ত্তশাসনের আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয় এবং নয় মাসের সশস্ত্রযুদ্ধ-জয়ের মাধ্যমে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করে। যেহেতু, শুরু থেকেই এই সংগঠনের সাহস আর শক্তির জায়গা ছিলো জনগণ এবং এই জনগণ কখনোই বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগকে ছেড়ে যায়নি; অতএব, জয়ী হয় বাঙালি, জয় হয় আওয়ামী লীগের। 

যেহেতু একটা পক্ষ (জামাত ও মৌলবাদী গুষ্টি) আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, যুদ্ধাপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো, তারা নিজেরা এবং তাদের উত্তর প্রজন্ম এই দেশকে মেনে নেয়নি; সুতরাং শুরু থেকেই তারা পাকিস্তানের সাথে ন্যুনতম হলেও একটা 'আদর্শিক' (মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী) গাঁটছড়া বাঁধার পায়তারায় লিপ্ত ছিলো। '৭৫ এ জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী বিরোধী যে প্লাটফর্ম মুক্তিযুদ্ধের 'অন্যতম সেক্টর কমান্ডার' জিয়াউর রহমানের (যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ভূমিকা পালন করার অভিযোগ আছে) নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই প্লাটফর্মে ডান-বাম-মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার সবাই একাকার হয়ে যায় এবং তারা প্রথমোক্তদের রাজনীতিতে শুধু পুনর্বাসনই করেনি, শক্তিমত্তাও জুগিয়েছে।

এই গোষ্ঠী-ই আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ একুশ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে রাখে। '৮১তে জননেত্রী শেখ হাসিনা'র স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আওয়ামী শিবিরে যে প্রাণের সঞ্চার হয় তার ফলশ্রুতিতে '৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হয়।
সেই থেকে '২৪ এর ৫ আগষ্ট (২০০১ থেকে ২০০৮ বাদে) পর্যন্ত যে তিনটি কাজ বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তার একটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, অপরটি যুদ্ধাপরাধের বিচার আর তৃতীয়টি অভূতপূর্ব উন্নয়ন। সুতরাং এই প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতিকে বৈধতার মোড়ক দেবার সঞ্জীবনী এজেন্ডা নিয়ে ড: ইউনুসের ম্যাটিকুলাস ডিজাইন ৫ আগষ্টে বাস্তবায়িত হয়েছে; যেখানে সুচতুরভাবে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ছিলো। 

অতএব, এখানে আকাশ থেকে পড়ার মতো কিছু নেই। আমাদের মতো ছোটো-ছোটো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদী আপোষহীন নেতৃত্ব ক্ষমতায় থাকলে, একইসাথে দেশটি সম্ভাবনাময় হলে, সেটা চক্রান্তকারীদের খেলার মাঠ হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে - আমরা এই চক্রান্ত ধরতে পারিনি কেনো! কিংবা ধরতে পারলে এটা নস্যাৎ করতে পারিনি কেনো! এদেরকে পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ম্যান্ডেটতো বাংলাদেশের মানুষই আমাদেরকে দিয়েছিল। সুতরাং, আওয়ামী লীগ তার নিজের প্রয়োজনেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।

৫ আগষ্টের পর থেকে যে নতুন-নতুন বয়ান আর বন্দোবস্তের কথা আমরা শুনছি তার একটি বয়ান হলো - 'আওয়ামী লীগতো এখনো ক্ষমা চাচ্ছেনা কিংবা তাদের মধ্যেতো কোনো অনুশোচনা পরিলক্ষিত হচ্ছেনা'! আওয়ামী লীগের সভাপতি, বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর জায়গা থেকে যখনই সঠিক-সময় বিবেচনা করবেন, নিশ্চয়ই এই 'বয়ানের' জবাব দেবেন তবে, আমি দলের একজন তৃণমূল কর্মী হিসেবে এর উত্তর নয়, আমার নিজস্ব উপলব্ধির কথা বলতে পারি __

> আমার অনুশোচনা হচ্ছে যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে রাজাকাররা দোর্দন্ড প্রতাপে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করছে, অথচ আমি কিছুই করতে পারছিনা।
> আমার অনুশোচনা হচ্ছে যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আতুড়ঘর ৩২ গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আমি শুধু চেয়ে-চেয়ে দেখা আর চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি।
> আমার অনুশোচনা হচ্ছে যে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে পার পেয়ে যাচ্ছে অথচ আমি কিছুই করতে পারছিনা। 
> আমার অনুশোচনা হচ্ছে যে তিরিশ লক্ষ শহীদ আর দুলক্ষ মা-বোনের রক্তে রঞ্জিত সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার দু:সাহস দেখাছে স্বাধীনতা বিরোধীরা অথচ আমি কিছুই করতে পারছিনা।
> আমার অনুশোচনা হচ্ছে যে জাতিরপিতার ভাষ্কর্য, বীরশ্রেষ্ঠদের ভাষ্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাঙা হয়েছে, অপমানিত করা হয়েছে, আমি ঠেকাতে পারিনি।
> আমার অনুশোচনা হচ্ছে যে রাষ্ট্রীয় মদদে মবতন্ত্র সৃষ্টি করে দেশকে শুধু অরাজকতার দিকেই ঠেলে দেয়া হচ্ছেনা, বাঙালির চিরায়ত মূল্যবোধ গুলোকেও একে একে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে, অথচ আমি কিছুই করতে পারছিনা।
> আমার অনুশোচনা হচ্ছে যে '৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে (খুণী মোশতাকের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যা জিয়াউর রহমানের বদৌলতে সংসদে বিল আকারে পাশ হয়েছিল) যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল, আজকে ড: ইউনুসের হাত দিয়ে আবারো ইনডেমনিটি সংস্কৃতি চালু হয়েছে, অথচ আমি কিছুই করতে পারছিনা।
ইত্যাদি, ইত্যাদি... 

আওয়ামী লীগ '৭১ এর মতো কিংবা আওয়ামী লীগ '৭৫ পরবর্তীতে যেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তেমনিভাবে আবারো ঘুরে দাঁড়াবে বাংলার মানুষের ভালোবাসার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে। তারজন্য সেইসব মানুষদের কাছে আবারো ফিরে যেতে হবে, দীর্ঘদিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার কারণে যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে থাকে, সেই দূরত্ব ঘোচাতে। সীমাবদ্ধতা মানুষের যেমন থাকে, মানুষ-পরিচালিত রাজনৈতিক দলেরও থাকা স্বাভাবিক। বাঙালি, বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে তার নিজের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে; এই সম্পর্ক রক্তের, এই সম্পর্ক আত্মার। মানুষই আওয়ামী লীগকে বারবার দেশের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে, আওয়ামী লীগ যদি মানুষের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারে, তাহলে মানুষের এই অধিকার অবশ্যই আছে আওয়ামী লীগের উপর বিরক্ত হবার। সুতরাং এটা আওয়ামী লীগ দেখবে আর দেখবে বাংলাদেশের মানুষ। এটার জন্য ড: ইউনুস কিংবা তার বশংবদদের কাছ থেকে কোনো 'বয়ান' বিতরণের দরকার নেই। আমিতো বরং মনে করি এই দুষ্টচক্রকে সময়মতো প্রতিহত করতে না পারার জন্যই আমাদের উচিৎ বাংলার মানুষের কাছে নি:শর্ত ক্ষমা চাওয়া; এবং, এই বিশ্বাসে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ একদিন এই দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে আর একাত্তরের মতো সেই যুদ্ধের নেতৃত্বও দেবে আওয়ামী লীগ। ইনশাআল্লাহ।

লেখক জনাব- হরমুজ আলী 
সহ-সভাপতি, যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ।

লন্ডন, ২৫ জুন ২০২৫

সর্বশেষ

জনপ্রিয়