রোববার , ২০ এপ্রিল ২০২৫
Sunday , 20 April 2025
২১ শাওয়াল ১৪৪৬

আবু মকসুদ

প্রকাশিত: ১৬:৪৭, ১৯ মার্চ ২০২৫

#বৃক্ষেরা_শুধু_দেখে_কিন্তু_বলে_না

#বৃক্ষেরা_শুধু_দেখে_কিন্তু_বলে_না

#বৃক্ষেরা_শুধু_দেখে_কিন্তু_বলে_না

ভর দুপুর। সূর্য মাথার ওপর অগ্নিগোলক, যেন আকাশের বিশাল তন্দুর থেকে আগুন ঝরছে। বাতাসে শুধু বাঁশঝাড়ের মাথা দুলছে কোনো এক অদৃশ্য হাতের ঠেলায়, যা দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কাজিনের মনে হচ্ছিল, বাঁশের ডগাগুলো যেন নিঃশব্দে তার পিছু নিচ্ছে, প্রতিটি পদক্ষেপের ছায়া হয়ে। হঠাৎই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া, যেন কেউ গলা চেপে ধরেছে; শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল মুহূর্তের জন্য। চোখ খুললেই বাজারের নিচে পড়ে থাকতে দেখল নিজেকে। শরীরে কাদা, জিভে লবণের স্বাদ কেন? কীভাবে? আশপাশের মানুষজন বিস্ময়ে তাকিয়ে, কৌতূহল আর ভয়ের মিশেলে ফিসফাস করছে। গ্রামের ওঝা এসে বললেন, "বাঁশঝাড়ের ভূত... দুপুরেও ওরা জাগে।" তার কণ্ঠে ছিল নিঃসন্দেহ সতর্কবার্তা, যেন বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা কোনো গোপন সত্য।

এই গল্পের মতো অজস্র কিস্সা ছড়িয়ে আছে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, মানুষের মুখে মুখে ফিরছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। বৃক্ষকে দোষী সাজানোর এই রীতি শুধু লোককথার ফসল নয়; সাহিত্যের গহিনে এর শেকড় পোঁতা আছে গভীরভাবে। বিশ্বজুড়ে বৃক্ষ মানে শুধু কাঠ-পাতা নয় এরা কখনো অশুভের আধার, কখনো ভূতের বাসা, আবার কখনো অমরত্বের প্রতীক। বাংলা সাহিত্যে এর প্রতিচ্ছবি আরও গাঢ়, যেন শ্যাওলা ধরা প্রাচীন দেয়ালে আঁকা রহস্যময় চিত্রকথা, যার ভাষা সবাই বোঝে না, কিন্তু অনুভব করতে পারে। ফোকলোরের বাঁকে বাঁকে, উপকথার অলিতে-গলিতে গাছেরা কেবল নীরব সাক্ষী নয়, বরং নিজস্ব চরিত্র হয়ে ওঠে—ভয় দেখায়, আশ্রয় দেয়, শাস্তি দেয়, আবার কখনো আশীর্বাদও করে।

গ্রীক পুরাণে ড্যাফনে নামের এক নদীকন্যা পালাচ্ছিল অ্যাপোলোর কামনা থেকে, ভয় আর প্রতিরোধের শেষ সীমায় পৌঁছে। শেষমেশ সে এক জলপাই গাছে পরিণত হয়, যেন তার মুক্তি আর বন্দিত্ব একসাথে বাঁধা পড়ে গেল সেই বৃক্ষের শরীরে। কিন্তু এই রূপান্তর কি সত্যিই মুক্তি, নাকি বৃক্ষের শরীরে চিরকালের বন্দিদশা? ওভিডের মেটামরফোসিস-এ এই গাছের বাকল যেন ড্যাফনের চিৎকার ধরে রেখেছে, তার হতাশা আর আকুতির নীরব অনুরণন ছড়িয়ে পড়েছে পাতার ফিসফিসানিতে। একইভাবে, বাংলার রূপকথায় বটগাছের ঝুরি, বয়োবৃদ্ধ পিপুলের শাখা, আর বাঁশঝাড়ের গভীর অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা রহস্য আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে যেন কোনো এক অনন্ত গল্পের অংশ হয়ে আছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়।

জাপানের আইনু সম্প্রদায় বিশ্বাস করে, কদম গাছে বাস করে কাপ্পা জলভূত। এই কাপ্পারা শুধু জলেই নয়, কখনো কখনো গাছের ডালেও বিশ্রাম নেয়, মানুষের অগোচরে। তাদের সম্পর্কে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে কেউ বলে, তারা ছোট শিশুদের পানিতে টেনে নিয়ে যায়, আবার কেউ বলে, তারা আসলে গাছের অভিভাবক। মিয়াজাকির মোনোনোক হিমে চলচ্চিত্রে বনের দেবতারা গাছের রূপে কথা বলে, তাদের ক্রোধে অরণ্য উজাড় হয়। এই ধারণাটি আসলে জাপানের প্রকৃতি-আশ্রিত শিন্তো বিশ্বাস থেকে এসেছে, যেখানে গাছ ও নদীকে জীবন্ত আত্মা হিসেবে কল্পনা করা হয়। আফ্রিকান ইয়োরুবা মিথে ইরোকো বৃক্ষ দেবতা, কিন্তু তার ছায়ায় ঘুমালে আত্মা চুরি হয়। ইরোকো গাছের নিচে বসা বা ঘুমানো বিপজ্জনক বলে মনে করা হয়, কারণ গাছটি নাকি ধীরে ধীরে মানুষের আত্মাকে শুষে নিতে পারে, আর রাত হলে তার ডালে ডালে অদ্ভুত আলো দেখা যায়।

ইউরোপীয় সাহিত্যে শেকসপিয়রের ম্যাকবেথ নাটকে বার্নাম উডের গাছগুলো হেঁটে আসে দুর্গের দিকে প্রকৃতির প্রতিশোধ। এই প্রতিশোধের ধারণা শুধু নাটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মধ্যযুগীয় বিশ্বাসের অংশ ছিল যে, প্রকৃতি মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে। ম্যাকবেথের ক্ষেত্রে, এই গাছেরা সত্যিকার অর্থে হাঁটছিল না, কিন্তু সৈন্যরা গাছের ডালপালা ধরে এগোচ্ছিল, যা এক ধরনের প্রতীকী প্রতিশোধ। আর মার্কেসের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড-এ সেই বিখ্যাত চেস্টনাট গাছ, যার নিচে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বরফের মতো ঠাণ্ডা হৃদয় গড়ে উঠেছিল। গাছটি কেবল স্মৃতির বাহক নয়, বরং সময়ের প্রবাহ ও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ওঠে। লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতায় এই গাছ শুধু একটি উদ্ভিদ নয়, বরং আত্মা, সময়, আর নিঃসঙ্গতার প্রতীক।

বাংলা সাহিত্যে বৃক্ষ শুধু প্রাণ নয়, চরিত্র। রবীন্দ্রনাথের "ক্ষুধিত পাষাণ" গল্পে পাথর-খাওয়া বটগাছ মানুষের রক্ত চায়। তার ডালপালা যেন অদৃশ্য হাত, অরণ্যের নীরবতা ভেঙে বলে "মৃত্যুই শেষ কথা নয়।" এই বটগাছ কেবল ভূতের গল্পের অংশ নয়, বরং প্রকৃতির এক অনিশ্চিত শক্তির প্রতীক, যা মানুষকে ভয় দেখায় এবং নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। এই ধরনের গাছের উপস্থিতি বাংলার লোককথায় বহুবার উঠে এসেছে, যেখানে গাছকে অশরীরী সত্তার আশ্রয়স্থল হিসেবে কল্পনা করা হয়।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক-এ শালবনের গহিনে এক ধরনের 'সত্তা' থাকে। অরণ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো যেন চিরকালীন নীরব দর্শক, যারা মানুষের আনন্দ, দুঃখ, ইতিহাস সবই চুপচাপ দেখে যায়। সত্যজিৎ রায়ের "বনকুবাবুর বন্ধু" গল্পে সেই বটগাছ, যার গুঁড়িতে লুকিয়ে আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোপন ধন আর তার রক্ষী হিসেবে ভূত। এই ভূত কেবল অতীতের রক্ষক নয়, বরং একটি সাম্রাজ্যের পতনেরও প্রতীক। শহীদুল জহিরের গদ্যভাষায় প্রকৃতি এক নীরব দর্শক, ইতিহাসের সাক্ষী, কিন্তু অতিপ্রাকৃত শক্তির আধার নয়। 'আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু' কিংবা 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'য় গাছ আছে, ছায়া আছে, কিন্তু তারা ভূতের আতঙ্ক ছড়ায় না, বরং বাস্তবতার এক জটিল প্রতিচিত্র তৈরি করে।"

কেন বৃক্ষকে অভিশাপ দেওয়া হয়? মনোবিদ্যার ভাষায়, মানুষের অজ্ঞানতার ভয় প্রকৃতিকে দানব করে তোলে। সমাজবিজ্ঞান বলবে গাছকে ট্যাবু করে রাখাই সমাজের নিয়ন্ত্রণ কৌশল; অরণ্য কাটা বন্ধ করতে ভূতের গল্প তৈরি। কিন্তু সাহিত্য এই ভয়কে রূপ দেয় অন্য মাত্রায়।

শহীদুল জহিরের গদ্যভাষায় বৃক্ষ শুধু পটভূমি নয়, সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তার "ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প"-এ এক ডুমুর গাছ মানুষের মতো ক্ষুধার্ত, তার শিকড় খুঁজে ফেরে মাটির নিচের স্মৃতিগুলো। এখানে গাছ মানে ইতিহাসের সাক্ষী, বা হয়তো অপরাধী।

গ্রামের লোককথায় ভূত রাতের প্রাণী। কিন্তু সাহিত্য সময় ভাঙে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের "লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা"-তে ম্যানগ্রো গাছের নিচে প্রেমিকেরা মিলিত হয় দুপুরেই, আর গাছের পাতায় জমে থাকে তাদের অকথিত যন্ত্রণা। বাংলার বাঁশঝাড়ও সেই রকম দুপুরের রোদে যখন ছায়াগুলো তীক্ষ্ণ হয়, তখনই হয়তো অদেখারা সবচেয়ে সক্রিয়।

বিশ্বজুড়ে গাছের এই 'দোষী' সত্ত্বা আসলে মানুষেরই অর্ধেক-বলা গল্প। সাহিত্য সেই গল্পকে পূর্ণতা দেয়, তাকে করে তোলে চিরন্তন। বাংলার মাটিতে এর স্বাদ আলাদা এখানে বৃক্ষ শুধু ভূতের বাসা নয়, ইতিহাসের আকর, রাজনীতির প্রতীক, কিংবা প্রেমের সাক্ষী।

বাংলার গ্রামগঞ্জের আরো গভীরে গেলে শোনা যায় নানা অলৌকিক কাহিনি। গ্রামের প্রাচীনতম বটগাছের নিচে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাতাস অস্বাভাবিকভাবে থেমে যায়, যেন কিছু একটা অপেক্ষা করছে। শিমুল গাছের শুকনো পাতা একা একা দুলতে থাকে, অথচ আশেপাশে বাতাসের অস্তিত্ব নেই। বয়স্করা বলেন, এসব গাছের নিচে বহু বছর আগে কেউ না কেউ মরেছে, আর তাদের আত্মা গাছের সাথে লেপ্টে আছে।

বাংলা সাহিত্যের আরেক চমৎকার উদাহরণ হলো তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বনপলাশীর পদাবলী, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়াবহতার এক অনবদ্য চিত্র ফুটে উঠেছে। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা গাছ, বিশেষ করে কুসুম গাছ, কেবল প্রকৃতির একটি অংশ নয়; এটি এক রহস্যময় সত্তা, যার নিচে বসলে নাকি মনে হয় কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, এই গাছের নিচে বসলে অপদেবতা এসে মানুষকে ধীরে ধীরে মোহগ্রস্ত করে ফেলে, তাদের ভুলিয়ে নিয়ে যায় এক অজানা জগতে। অন্ধকার নামার পর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যখন চাঁদের আলো মাটিতে পড়ে, তখন সেই ছায়াপথের মধ্যে কেউ কেউ অদ্ভুত আকৃতির অবয়ব দেখতে পায়। বয়স্করা বলেন, যারা কুসুম গাছের অভিশাপের কথা জানে না, তারাই রাতে এই গাছের নিচে বসে এবং পরদিন তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই অলৌকিকতার ভয়াবহ উপস্থিতি গ্রাম্য কল্পকথার মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং সাহিত্যের পাতায় এসে চিরস্থায়ী হয়।

গাছের সাথে এই ভয় ও রহস্যময়তার সম্পর্ক শুধু গ্রামেই সীমাবদ্ধ নয়, শহরেও তা প্রবলভাবে টিকে আছে, যদিও তার রূপ ভিন্ন। পুরনো ঢাকার পুরনো বাড়ির সামনে বিশাল অশ্বত্থ গাছ, যার কাণ্ডে অসংখ্য গুটিপোকা আর বটমূলের শেকড় ঝুলে আছে, যেন প্রকৃতির এক ভয়ংকর আঁধার। লোকমুখে শোনা যায়, গভীর রাতে সেখানে একটি ছায়ামূর্তি দেখা যায়, যেটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় গাছের ডালপালার মধ্যে। কেউ কেউ বলে, সেই ছায়ামূর্তি এক হতভাগা নারী, যে বহু বছর আগে এই বাড়িতেই আত্মহত্যা করেছিল এবং তার আত্মা আজও অশ্বত্থ গাছের মধ্যে বন্দী। ঠিক যেমন বিভূতিভূষণের গল্পে দেখা যায়, প্রকৃতি কেবল প্রকৃতি নয়, সে রহস্যময়তার এক বিরাট আধার। বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়ানো মানুষ যখন অনুভব করে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে, তখন সে হয়তো উপলব্ধি করে যে, প্রকৃতির এই নিরব উপস্থিতি কেবলমাত্র জীবনের প্রতিচ্ছবি নয়; এর গভীরে লুকিয়ে আছে অতীতের না-বলা গল্প, এক অনিবার্য আতঙ্ক।

ভর দুপুরে কাজিনের ঘটনাটি হয়তো কাল্পনিক, কিন্তু বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে হাঁটতে আজও গ্রামবাসীরা তাড়াতাড়ি পা চালায়, যেন দেরি করলেই কিছু একটা তাদের ছুঁয়ে ফেলবে। বাঁশের পাতাগুলি যখন বাতাসে সরসর শব্দ তোলে, তখন মনে হয়, কে যেন আড়ালে ফিসফিস করছে, হয়তো পুরনো কোনো অতৃপ্ত আত্মা। গ্রামের বৃদ্ধেরা বলেন, অনেক আগেই এক যুবক সেখানে আত্মহত্যা করেছিল, তার চিতার ধোঁয়া এখনো রাতে ওই বাঁশঝাড়ের ফাঁকে মিশে থাকে। এই ভয়ানক উপাখ্যানই সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে, সেই ভয়ের অনুভূতিকে জমিয়ে রাখে পাতার পরতে পরতে। যতদিন মানুষ গল্প বলে, ততদিন এই দোষী বৃক্ষের ছায়া নিয়ে লেখা হবে নতুন পাতা, নতুন গল্প, নতুন অভিশাপ।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়