এমন ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত: এতসব মৃত্যুর দায় কার?

দুঃস্বপ্ন এখনো ভুলতে পারছে না বাংলাদেশ। গোটা জাতি হত-বিহবল। এর মধ্যে ৩৭টি প্রাণ চলে গেছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিভু নিভু প্রদীপের মতো জ¦লছে যেসব প্রাণ; তাদেরও বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ প্রায় একশত পোড়া রোগীর অন্তত ৬৫ জনের অবস্থা গুরুতর। দেশের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। সিঙ্গাপুর, ভারত, চীন থেকেও চিকিৎসক ও নার্স আনা হয়েছে। সর্বচেষ্টা ব্যর্থ করে না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। বেড়েই চলছে লাশের মিছিল। একেক জন মায়ের বুক খালি হচ্ছে। স্বজনের আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হচ্ছে, থেমে যাচ্ছে জীবনের গল্প।
মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের ক্যাম্পাসটা একেবারেই অপ্রস্তত ছিল। মর্শিয়া সাহিত্যে এমন ক্রন্দন কেউ দেখেনি। সেই অশ্রু সিক্ত বেদনার কাব্য বাস্তবে দেখল বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অথরিটি (আইকাও) এর অ্যানেক্যটু এবং অ্যানেক্স ইলেভেন অনুযায়ী, যে কোন প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে জনবসতিপূর্ণ এলাকার উপর দিয়ে কম উচ্চতায় উড়ালকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে, ন্যূনতম নিরাপদ অল্টিটিউড বজায় রাখা বাধ্যতামূলক, বিশেষ করে ঘনবসতি ও ক‚টনৈতিক এলাকা গুলোর ক্ষেত্রে। যেসব দেশ জননিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয় সেসব দেশের মানব বসতি এলাকায় সামরিক বা বেসামরিক কোন বিমান প্রশিক্ষণ হয় না। জাপানে শহরের উপর প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ, বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ হয় সমুদ্রের উপর বা নির্জন এলাকায়। যুক্তরাষ্ট্র জনবসতীর ওপর কম উচ্চতায় প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
প্যারিস শহরের আকাশে কোন প্রশিক্ষণ বিমান দেখা যায় না, শুধু বিশেষ অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট অনুমতিতে। ভারতের নয়াদিল্লিতে কম উচ্চতায় সামরিক বিমান নিষিদ্ধ। প্রশিক্ষণ হয় উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্রের বিশাল ঘরানার সামরিক ঘাঁটিতে। জনবসতি এলাকায় যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ চালানো শুধু নিরাপত্তার ঝুঁকি নয়, এটি আন্তর্জাতিক নিয়ম, মানবিক দায়বদ্ধতা ও পরিবেশগত বিবেচনার ও ব্যত্যয় । যুদ্ধবিমান অত্যন্ত দ্রæত গতিতে ছুটে। যেকোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা বৈমানিকের ভুলে জনবসতিতে বিধ্বস্ত হলে ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংস হতে পারে। যুদ্ধবিমানের শব্দ ১২০- ১৪০ ডেসিমেল পর্যন্ত হতে পারে, যা শ্রবন শক্তি হ্রাস স্ট্রেস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থদের উপর এর প্রভাব মারাত্মক। হঠাৎ বিকট শব্দ, ঘন ঘন উড়ার শব্দে মানুষ আতঙ্কিত হয়। স্কুল, হাসপাতাল, পরীক্ষার সময় এসব ফ্লাইট বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর দেশব্যাপী চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো উদ্ধার, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাছাড়া রাজধানীর আকাশে নিয়মিত যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন কতটা নিরাপদ? আন্তর্জাতিক নিয়ম কি এর অনুমতি দেয়? স্বাভাবিক ভাবনাতেই প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু যারা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক তাদের ভাবনায় কেন আসে না?
শোক আর দুঃখের সাগরে ভাসছে পুরো দেশ। নিরাপরাধ অবুঝ শিশু শিক্ষার্থীদের অকাল মৃত্যুর যন্ত্রণা যেন মা-বাবা আর স্বজনদের ছাড়িয়ে সংক্রমিত করেছে পুরো দেশের মানুষকে। একেকটি পুড়া দেহের যন্ত্রণা যেন শ্রেণী, পেশা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কেউই এ ধরনের মর্মান্তিক, অমানবিক ও করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না। শুধু মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজেই নয়, গোটা বাংলাদেশটা যেন নির্বাক শোকে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। কোমলমতি শিশুদের মৃত্যু আর দগ্ধ শিশুদের যন্ত্রণার কষ্ট সইতে না পেরে কাঁদছে পুরো দেশ।
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে জুলাই সোমবার দুপুরে বিকট শব্দ করে আছড়ে পড়ে বিমান বাহিনীর এক যুদ্ধবিমান। কী ঘটেছিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমানে? ‘এফ-৭ বিজিআই’এ। স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনার
পর এমন প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ অধিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি ৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার দুপুর ১ টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার বিমান বাহিনীর এ কে খন্দকার ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রæটির সম্মুখীন হয়। এ দুর্ঘটনা মোকাবিলা এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিমান বাহিনীর বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোঃ তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার শিকার হয়।
জানা যায়, সাধারণত ট্রেনিং ফ্লাইটগুলো জনবসতি থেকে দূরে পরিচালিত হয়। তবে সৌল-ফ্লাইট ট্রেনিং অনেক সময় শহরের আকাশপথেই সম্পন্ন হয়, সেটির জন্য প্রয়োজন হয় উচ্চ মাত্রার দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস। তৌকির ছিলেন এমন একজন কোয়ালিফাইড পাইলট। উড্ডয়নের পর তিনি উত্তরা, দিয়াবাড়ি, বাড্ডা, হাতিরঝিল ও রামপুরা এলাকা হয়ে উড়ছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বিমানে কারিগরি সমস্যার আভাস পান এবং কন্ট্রোলরুমে জানান, বিমানটি নিচের দিকে নামছে স্বাভাবিকভাবে ভেসে থাকার ক্ষমতা হারাচ্ছে বলে বার্তা দেন। তাৎক্ষণিকভাবেই কন্ট্রোল রুম থেকে তাকে ইজেক্ট (জরুরি অবস্থায় পাইলটের সিট খুলে তাকে বের করে দেওয়া) করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে, তৌকির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিমানটি বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন এবং সর্বোচ্চ গতিতে বিমানটিকে ঘুরিয়ে এয়ারবেসের দিকে ফেরার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে হঠাৎ কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মাত্র ১ থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিধ্বস্ত হয়। ঘটনার সূত্রপাত হয় ২১ জুলাই সোমবার বেলা শোয়া ১ টায়। ক্লাস ছুটির পর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় কোমলমতি ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। বাইরে ছিলেন অভিভাবকেরা। আবার কোন কোন শিক্ষার্থী প্রস্তুতি নিচ্ছিল কোচিং করার। অন্যান্য দিনের মতো কোলাহলপূর্ণ ছিল রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গণ। হঠাৎ প্রতিষ্ঠানটির একাডেমিক ভবনে আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান। বিদ্যুৎ গতিতে ঢুকে পড়ল জুনিয়র শিক্ষার্থীদের ক্লাস ভবনে। বিস্ফোরণ হল বিমানটি। প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠল পুরো এলাকা। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লো আগুনের লেলিহান শেখা। ওই আগুনে ঝলসে যায় বিপুলসংখ্যক কোমলমতি শিক্ষার্থীর দেহ। পুড়ে অঙ্গার হয়েছে কেউ কেউ। ভবনের ভেতর পড়ে ছিল অনেকের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
এরপর হতাহতদের নিয়ে ছুটেছে সবাই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। এ খবর নিমেষেই ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি কেউ। শুধু অভিভাবক, শিশুদের স্বজন নয়, কান্নার রোল পড়ে ঘরে ঘরে। স্কুল প্রাঙ্গণ ও হাসপাতালগুলোতে হতাহতের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। তবে জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে অন্তত ১১ জন। সব মিলিয়ে সরকারি হিসেবে মোট ৪৭ জনের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছে। যদিও আরো অনেক শিক্ষার্থী নিখোঁজ থাকায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রায় ১৮৫ জন।
অন্যদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চলমান এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো নিয়ে আনাড়িপনার পরিচয় দেওয়ায় অভিযোগে সচিবালয় ঘেরাও করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে গেট ভেঙে তারা ভেতরে প্রবেশ করে এবং শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিবের পদত্যাগ দাবি করে। এই নিয়ে পুরো সচিবালয় এলাকার রনক্ষেত্রে পরিণত হয়। শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করা হলেও নেভেনি ক্ষোভের আগুন। দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এই সময় অন্তত ১২০ শিক্ষার্থী আহত হয়। কিন্তু মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজ এখন নিঃশব্দ এক মৃত্যুপুরী। শোকে স্তব্ধ মুহ্যমান। অনেক অভিভাবক ও নির্বাক ও নিস্তব্ধ। প্রতিদিন যেখানে থাকতো কোলাহল আর পড়ার শব্দে মুখর। এখন ক্লাস রুমগুলো খালি-সুনশান। ভবনের করিডোরে নেই কোলাহল- শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি। বাতাসে ভাসছে পোড়া গন্ধ।
যারা এখনো নিখোঁজ তাদের স্বজনদের মরদেহের সন্ধানে ছুটতে দেখা যাচ্ছে এদিক-সেদিক। মিডিয়ার কাউকে পেলেই ছবি দেখিয়ে জানতে চায় তার কোন খোঁজ আছে? সহপাঠী-সহকর্মীদের জীবনে এমন চরম বিয়োগান্ত দশা নেমে আসবে এমনটি ছিল কল্পনাতীত। যারা পুড়ে মরছে আর যারা প্রাণে বেঁচেছে তাদের স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের একটাই প্রশ্ন কেন এভাবে তাদের মরতে হলো?
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমান বিধ্বস্ত নিয়ে সরকারের ভ‚মিকা প্রশ্নের মুখে। ঢাকায় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের হতাহতের মর্মান্তিক ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার সমন্বয়হীনতা ও ব্যর্থতার নজির স্থাপন করেছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। এই ঘটনায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে জনবহুল এলাকায় কেন যুদ্ধবিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হল এবং এ ঘটনার দায় কার? যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণের সময় বিধ্বস্ত হয়ে স্কুলটিতে আছড়ে পড়লে শিশুদের মর্মান্তিক মৃত্যু হতাহতের ঘটনা দেশজুড়ে মানুষের মাঝে আবেগ সৃষ্টি করে। কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েই প্রশ্ন উঠে এবং নানা আলোচনার জন্ম দেয় বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। তারা বলেছেন, এই ঘটনায় সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি, সমন্বয়কদের ঘাটতি, দক্ষতার অভাব স্পষ্ট হয়েছে। বড় কোন দুর্ঘটনা সামাল দিতে জাতীয় সক্ষমতা, ব্যবস্থাপনা, কতটা ভঙ্গুর তা আরেকবার প্রকাশ পেয়েছে (২৫ জুলাই ২০২৫, আজকাল)। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো একদম শিশু বাচ্চারা এই ঘটনায় নিহত হয়েছে বেশি। অন্যদিকে উড্ডয়নের আগে বিমানটি যথাযথ কারিগরি পরীক্ষা করা হয়নি এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গত দুই দশকে বাংলাদেশের বিমান বাহিনীতে রেকর্ড করা ১১টি বিমান দুর্ঘটনার মধ্যে সাতটি এফ-৭ সিরিজের চীনা বিমান জড়িত ছিল। যা ক্রমাগত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দিয়ে আসছিল। তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় নি কর্তৃপক্ষ। প্রথম একটি এফ৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ঢাকা থেকে ৮৩ কি.মি দূরে টাঙ্গাইলে একটি গ্রামে বিধ্বস্ত হয়। যার ফলে এর পাইলট মোর্শেদ হাসান নিহত হন। যুদ্ধ বিমানটির প্যারাসুট ঠিকমতো কাজ করেনি বলে জানা যায় । ২০১৫ সালের জুন মাসে আরেকটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বঙ্গোপসাগরের উপক‚লে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কাছে বিধ্বস্ত হয়। পাইলট লেফটেন্যান্ট তাহমিদকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলে আরেকটি প্রশিক্ষণ সেশনের সময় এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। ঢাকা থেকে উড্ডয়নের মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যেই মাটিতে আছড়ে পড়লে ফুয়েল ট্যাঙ্কে আগুন ধরে যায়। পাইলট উইং কমান্ডার আরিফ আহমদ দিপু বেঁচে ফিরতে পারেননি। এফ-৭ বিমান গুলো বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে। কারণ তাদের বার্ধক্য এবং যান্ত্রিকভাবে অবিশ্বস্ত প্রকৃতি ও নিরাপদ ঢাকা শহরের ফ্লাইটের অবস্থার সাথে মিলিয়ে জীবনকে বিপন্ন করেছে। (আজকাল, ২৫ জুলাই ২০২৫)।
মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে ২২ জুলাই মঙ্গলবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়। এরই মধ্যে দিনভর ঢাকা শহরে ছিল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। দুর্ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন দুই উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও সি আর আবরার এবং প্রধান উপদেষ্টার সচিব শফিকুল আলম। সেই স্কুলে তারা নয় ঘন্টা অবরুদ্ধ ছিলেন। অন্যদিকে শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে সচিবালয় এলাকার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এর কারণ হিসেবে সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক- আবু আলম মোঃ শহীদ খান বলেন, দেশে এখন মবতন্ত্র চলছে। সরকার এমনিতে বলছে, মব করতে দেয়া হবে না, কিন্তু বাস্তবে সহযোগিতা করছে।
কারন বিভিন্নমব ঘটনার পর সরকার দাবি মেনে নিয়েছে। তাই মাইলস্টোনের ট্রাজেডিতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ও মবের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায় করতে চেয়েছে। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা সামলাতে সরকারের অব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ করার অন্যতম কারণ। তিনি আরো বলেন, অন্তবর্তী সরকারের কোন কোন উপদেষ্টার দিনে কোন কার্যক্রম দেখা যায় না। তাঁরা মধ্যরাতে সক্রিয় হন।রাত তিনটায় পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণা শোকাহত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক ধরনের মজা করার সামিল। পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত দুপুর তিনটার মধ্যে নেয়া যেত বলে মনে করেন তিনি। উক্ত ঘটনার পর শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করা মানে একজনের কাঁধে দায় চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা। পরীক্ষা স্থগিত হবে কিনা এই সিদ্ধান্ত সচিব একা নিতে পারে না, এর সঙ্গে শিক্ষা উপদেষ্টা শুধু নয়, প্রধান উপদেষ্টারও নির্দেশনার ব্যাপারও থাকে বলে মোঃ শাহিন মনে করেন।
বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ সচিবালয়ও ঢুকে পড়েছিল, এটা অন্তবর্তী সরকারের অদক্ষতা হিসেবে দেখছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ডা. আব্দুর নূর তুষার। তিনি বলেন, এই সরকার যে চাইলে বিক্ষোভ দমাতে বল প্রয়োগ করতে পারে সেটা কিন্তু গোপালগঞ্জ এ দেখা গিয়েছে। অথচ এই সরকারের সময়েই শিক্ষার্থীরা একাধিকবার বিক্ষোভ করতে করতে সচিবালায়ে ঢুকে পড়েছে। অথচ সেখানে পুরো দেশের সমস্ত নথি রয়েছে। তাই সচিবালয় এভাবে অরক্ষিত থাকলে পুরো দেশেই ঝুঁকিতে থাকবে মনে করেন তিনি।
এমন ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত অবশ্যই। এই ঘটনা জনবহুল স্থানে ঘটলে তার ব্যাপকতা কত হবে, তা তৌকির এর চেয়ে ভালো কেউ জানতেন না নিশ্চয়ই। তিনি নিশ্চয়ই এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। এরপর আর কি থাকে, হাহাকার ছাড়া (প্রথম আলো ২৪ জুলাই ২০২৫)। সেই হাহাকারে স্বর মেলাতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে, এ কেমন মহানগরী বানালাম আমরা? উত্তর এমনই এক রাজধানী শহর বানিয়েছি আমরা, যা বাসযোগ্যতার বিচারে বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে খারাপ তিনটি শহরের একটি। ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর ২০২৫ সালের গেøাবাল লিভোবিলিটি ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা এবার তিন ধাপ পিছিয়েছে। আছে ১৭১ তম অবস্থানে।
অবশ্য ২০২৫ সালের ২১ জুলাই, যে ঘটনা ঢাকা শহরের বুকে ঘটে গেল তা সূচকের সিদ্ধান্তকে আর কোন অজুহাত বা ব্যাখ্যাতেই অস্বীকার বা খারিজ করার জন্য ‘যদি, কিন্তু’ হাজিরের সুযোগ রাখেনি। আমরা স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এসে বলতে বাধ্য হচ্ছি , যে দেশের রাজধানী শহর এমনই এক অপরিকল্পনায় সৃষ্ট, যেখানে সকল ধরনের দুর্ঘটনাই ঘটতে পারে। কর্মস্থলের উদ্দেশ্য বা অন্য কোন কারণে বাসা থেকে বের হওয়াই যে আমাদের আপঘাতের শেষ যাত্রা নয়, তা কোন কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে পারেনা। অথচ এই দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে দৌড়াচ্ছে- এমন আপ্তবাক্য শুনতে শুনতে দীর্ঘকাল আমাদের কান পড়েছে। ঢাকায় বসে সিঙ্গাপুরের গল্প আমরা আগেও শুনেছি, এখনো শুনছি। বলা হচ্ছে দম্ভভরে। আর দিনশেষে শিশু বাচ্চাটার লাশ কোলে নিয়ে এই আমরা, নগরবাসী সময় গুনছি চোখের জলের অবিরাম বর্ষণ ঠেকানোর। আমাদের ল্যাক্রিমাল গø্যান্ডগুলো শুকিয়ে কাঠ হয় না কেন! আর কত কাঁদবো বলুন দেখি? কতটা কাঁদলে, কতবার পায়ে পড়লে আপনারা আমাদের বিশেষ করে আমাদের বাচ্চাদের একটা বাসযোগ্য নগরী দেবেন, বলুন না?
জানি, উত্তর আসবে না, কারণ ক্ষমতাসীনদের ধর্ম সবকালেই এক। রাজনীতি ও এক। সাধারণ জনতা সেখানে খরচ যোগ্য উপাদান মাত্র। জনতার কাছে ক্ষমতা থাকেনা, থাকে শুধু অন্তহীন হাহাকার, আহাজারি। যারা পুড়ে মরেছে আর যারা প্রাণে বেঁচেছে তাদের স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের একটাই প্রশ্ন কেন এভাবে তাদের মরতে হলো?
তবে এসবের মত মর্মান্তিক দুর্ঘটনার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক দশকে একের পর এক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার পরও মৌলিক পরিবর্তন আসেনি বিমান বাহিনীর বহরে। তাছাড়া পুরনো বিমানের পরিবর্তে যুক্ত হয়নি আধুনিক যুদ্ধবিমান।
বস্তুত মাইলস্টোন স্কুলের উপর বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়; এটিকে একটি ব্যস্ত রানয়ের পাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ নগর পরিকল্পনার এক মর্মান্তিক পরিণতি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, বিমানবন্দরের রানওয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকা উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য ‘হাই রিস্ক জোন’ বা সর্বোচ্চ ঝুঁকি অঞ্চল। এ ধরনের স্থানে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করার সিদ্ধান্ত শিশুদের জীবনকে সরাসরি বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ার সামিল। কেননা বিমান উড্ডয়ন বা অবতরণের সময় যান্ত্রিক ত্রæটি, বৈরী আবহাওয়া বা পাইলটের সামান্যতম ভুলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দুর্ঘটনা না ঘটলেও রানওয়ের পাশে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই রানওয়ের পাশে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও আবাসিক ভবন থাকা উচিত নয়।
ঢাকা শহরের যে অবস্থা তাতে বলাই যায়, এ শহরটি যেন অপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। যে যেভাবে পেরেছে, সে তার মতো করে ভবন তৈরি করেছে। যদিও এর পেছনে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার দাপট রয়েছে। নতুন করে এই শহরকে নিয়ে ভাবা দরকার। অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা প্রয়োজন। যখনই কোন দুর্ঘটনা ঘটে তখন এই বিষয়গুলো সামনে আসে। কিছুদিন পর তা নিয়ে আর আলোচনাই থাকে না। কারণ আমাদের মত দেশে দুঃশাসনের কারণে একটির পর একটি ঘটনা ঘটতেই থাকে। একটি ঘটনার বিচার হতে না হতেই আরেকটি ঘটনা পুরানো ঘটনাকে চাপা দিয়ে দেয়। সুতরাং কোন ঘটনারই সুষ্ঠু বিচার হয় না। পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশ যেখানে জীবনের যেন কোন মূল্য নেই। জীবনের মূল্য যদি থাকতো তাহলে এত অঘটনের বাংলাদেশ হতো না। হায়রে দুর্ভাগা দেশ এবং জনগণ।
শেষে বলল, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি আমাদের জন্য যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, সেটা অনুধাবন করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এখন উচিত হবে বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে নিরাপত্তার বিষয়টি নিরীক্ষা করা, আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে কঠোরভাবে ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠা এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের জন্য লোকালয় থেকে দূরে বিস্তীর্ণ মাঠ বা চরাঞ্চল অথবা অন্য কোন জায়গায় স্বতন্ত্র রানওয়ে নির্মাণ করা। ঢাকা একটি জনবহুল শহর যেখানে রয়েছে ঘন ঘন সুউচ্চ ভবন। এমন একটি শহরে যে কোন দুর্ঘটনা অনেক মানুষের প্রাণহানির কারণ হতে পারে বা হয়েছে। কাজেই এ ঝুঁকি নিরসনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এরকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধ বিমান চালানো না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্ঘটনায় পুনরাবৃত্তির রোধে সরকারকে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।
[লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট। লোকসংস্কৃতি গবেষক, রাষ্ট্রচিন্তক, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রাবন্ধিক। পিএইচডি ফেলো, নিউইয়র্ক ]