কুদালী_ছড়া_মৌলভীবাজারের_অশ্রুধারা

কুদালী_ছড়া_মৌলভীবাজারের_অশ্রুধারা
মৌলভীবাজারের হৃৎপিণ্ডে একদা স্নিগ্ধ ধারা বয়ে যেত – কুদালী ছড়া। বর্ষিজোড়া পাহাড়ের অঙ্ক থেকে উৎসারিত হয়ে, ১৭ কিলোমিটারের এক জীবন্ত আখ্যান রচনা করে, সে মিলিত হত হাইল হাওরের বিশাল বক্ষে। মাত্র ৪ কিলোমিটার শহরের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হলেও, সে ছিল এই জনপদের শ্বাস-প্রশ্বাস। শহরের জলমগ্নতার বোঝা সে কাঁধে তুলে নিত নিঃশব্দে; গ্রামের কৃষকের শ্যামল ধানক্ষেতে সঞ্চার করত প্রাণের স্পন্দন; তার নির্মল জলে দেশি মাছেরা খেলে বেড়াত অবাধে। সে ছিল প্রকৃতির অমোঘ দান, নগর ও নিসর্গের প্রাণবন্ত সেতু।
কিন্তু আজ? কুদালী ছড়া এক করুণ আর্তনাদে রূপ নিয়েছে।ভাটির দিকে মানবসৃষ্ট কারাগার – অবৈধ বাঁধ, মাছ ধরার কুটিল ফাঁদ, আর নাগরিকদের নির্লজ্জ আবর্জনার স্তূপ – তার মুক্ত গতিকে রুদ্ধ করেছে। শুষ্ক মৌসুমে সে শীর্ণ কঙ্কালসার, আর বর্ষায় পরিণত হয় এক উন্মত্ত অভিশাপে। পূর্ব গির্জাপাড়া, টিবি হাসপাতাল সড়ক, কাশীনাথ রোড – এ সব এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসম ঘোলা পানিতে নিমজ্জিত হয়। ছড়ার কণ্ঠে যেন চেপে বসেছে অন্ধকার, তার স্রোতধ্বনি স্তব্ধ হয়ে গেছে অবহেলার নীরবতায়।
একসময় জাগরণের দীপশিখা জ্বেলেছিলেন মেয়র ফজলুর রহমান। তাঁর দূরদৃষ্টি ও আন্তরিকতায়, স্থানীয় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শুরু হয়েছিল এক মহাযজ্ঞ – খনন ও শোধন। শহর তখন গভীর নিঃশ্বাস ফেলেছিল; জলাবদ্ধতার ভূত পালিয়েছিল লজ্জায়। তাঁর চোখে দেখা স্বপ্ন ছিল সুদূরপ্রসারী: পূর্ণাঙ্গ খনন, মজবুত সংরক্ষণ প্রাচীর, জনবান্ধব ওয়াকওয়ে। কিন্তু সেই স্বপ্নসাধ অঙ্কুরেই মরুভূমির কাঙালে পরিণত হয় বর্তমান কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার তপ্ত বালুতে। আজ পৌরসভার ৪ কিলোমিটার আংশিক প্রাণবন্ত, কিন্তু গ্রামের দিকে বিস্তৃত ১৩ কিলোমিটার পরিণত হয়েছে এক পরিত্যক্ত শ্মশানে। ইউনিয়ন পরিষদগুলোর নিষ্ক্রিয়তা আর পৌরসভার দায়িত্বহীনতার বিষবাষ্পে জর্জরিত তার অবয়ব।
আমরা, মৌলভীবাজারের সন্তানেরা, আজ অতীতের জন্য গভীর কাতরতায় আক্রান্ত। স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে সেই ছড়া – যার জল ছিল পানির মতো স্বচ্ছ, যার তীরে সবুজের মেলা বসত পাখির কূজনে। আজ তার স্থান দখল করেছে প্লাস্টিকের পাহাড় আর বিষাক্ত দুর্গন্ধের মেঘ। সেই জনপদপ্রেমী মেয়রের দূরদর্শী পরিকল্পনাগুলো আজ শুধুই ম্লান স্মৃতি, হারিয়ে যাওয়া সুরের মতো করুণ। প্রশ্ন জ্বালা হয়ে জাগে হৃদয়ে: কেন আমরা ভুলে গেলাম? কেন নীরব দর্শকে পরিণত হলাম, যখন রাজনৈতিক সংকীর্ণতা আর নাগরিক উদাসীনতা মিলে শ্বাসরোধ করছে আমাদের প্রাণের ধমনীর?
এই মৃত্যুযাত্রা চিরস্থায়ী হওয়ার নয়। কুদালী ছড়ার পুনর্জীবন চাইলে জরুরি সর্বস্তরের ঐক্যবদ্ধ জাগরণ:
সমন্বিত অভিযান: পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড – সকলের হাত মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ খনন ও টেকসই রক্ষণাবেক্ষণের রূপরেখা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। শহর ও গ্রামের অংশকে আলাদা না ভেবে একই সূত্রে গাঁথতে হবে।
চেতনার আলোকবর্তিকা: নাগরিকদের মাঝে জাগিয়ে তুলতে হবে দায়িত্ববোধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, স্থানীয় মিডিয়া – সকলকে নিয়ে গড়ে তুলতে হবে গণজাগরণ। নর্দমায় ময়লা ফেলা যেন সামাজিক অপরাধ হয়।
আইনের কঠোর হস্ত: অবৈধ দখল, বাঁধ নির্মাণ ও পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি। নিয়মিত নজরদারি ও দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অপরিহার্য।
ডিজিটাল পাহারাদার: ড্রোন, জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ছড়ার স্বাস্থ্য নিরন্তর পর্যবেক্ষণ। সমস্যা শনাক্তকরণ ও দ্রুত সমাধানে প্রযুক্তিকে করা হোক নির্ভরশীল সহায়ক।
অর্থের অকূট ভাণ্ডার: পৌরসভার নিজস্ব তহবিল, সরকারি অনুদান, বেসরকারি সংস্থার অংশীদারিত্ব – বহুমুখী উৎস থেকে নিশ্চিত করতে হবে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন।
কুদালী ছড়ার অশ্রুধারা আজ শহরের বুক চিরে বয়ে যায়। তার কান্না শুধু পানির নয়; তা এই জনপদের অবহেলিত ইতিহাসের, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিষ্পাপ দাবীর। সে আমাদের হাহাকার, আমাদের হৃদয়ের ধ্বনি। তার পুনরুজ্জীবন মানেই মৌলভীবাজারের পুনর্জন্ম। আগামী বর্ষায় যদি আমরা আবার তলিয়ে যেতে না চাই, যদি পূর্ব গির্জাপাড়ার শিশুরা স্কুলে যেতে চায় শুকনো পায়ে, তবে আজই জেগে উঠতে হবে। ছড়ার তীরে দাঁড়িয়ে তাকে বলতে হবে: "ভয় নেই, আমরা ফিরে এসেছি।" নইলে এই স্তব্ধতা, এই জলমগ্নতা, লিখে দেবে আমাদের সমষ্টিগত ব্যর্থতার অমোঘ অধ্যায়। ছড়া বাঁচলে শহর বাঁচবে, শহর বাঁচলে আমরা বাঁচব – এই সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করেই এগিয়ে যেতে হবে।