বিবিসির পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন: জুলাই-আগস্টের সহিংসতার নেপথ্যের সত্য

গত বছরর ৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সংঘটিত সংঘর্ষ ও থানায় হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে মূলত “নিরীহ, নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ” বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা তুলে ধরা হয়, যাতে ৫২ জনের প্রাণ হারানোর দাবি করা হয়েছে।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিবেদনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি যে, এর ঠিক আগে, এই যাত্রাবাড়ী এলাকাতেই একজন ছুটিতে থাকা পুলিশ সদস্যকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে একটি ফুটওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়। দেশব্যাপী পুলিশ সদস্য ও স্টেশনগুলোর ওপর ধারাবাহিক হামলার ঘটনাও এতে উপেক্ষিত থাকে।
গত বছরের ২০শে জুলাই, যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ ফুটওভারব্রিজে ট্যুরিম্ট পুলিশ ইউনিটের সদস্য মোক্তাদিরকে গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। হামলাকারীরা ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে উল্লাস করে। ট্যুরিস্ট পুলিশ কি আদৌ অস্ত্র বহন করে বা গুলি চালানোর অধিকার রাখে—এটি কি বিবিসি তদন্ত করেছে?
একইভাবে, ৪ঠা আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় বিক্ষোভকারীরা হামলা চালিয়ে ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। বিবিসি কি কখনও জানার চেষ্টা করেছে, সেদিন বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কতজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়?
এই সহিংসতা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন গত বছরের ৬ই আগস্ট জানায়, দেশজুড়ে ৪৫০টির বেশি থানায় ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। পাশাপাশি পুলিশের হাজার হাজার অস্ত্র এবং বিপুল পরিমাণ অ্যামুনিশন লুটপাট করা হয়। একইভাবে যদি ব্রিটিশ পুলিশের ওপরও হামলা হতো, তখন তারা কী করত? বিবিসি কি মনে করে, তারা ফুলের তোড়া ও ফলের ঝুড়ি নিয়ে হামলাকারীদের অভ্যর্থনা জানাত?
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো গত ২৩শে জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, ১৬ই জুলাই থেকে মাত্র এক সপ্তাহে ১১৩টি অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দেশজুড়ে বহু পুলিশ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রামপুরা টিভি ভবন, সেতু ভবন, বিভিন্ন উড়াল সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনসহ বহু সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করা হয়। কিন্তু এসব ধ্বংসাত্মক হামলার বিবরণ বিবিসির প্রতিবেদনে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
ড. ইউনূস ঘোষিত ‘জুলাই অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী’ মাহফুজ আলম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, ১লা জুন থেকে ১৮ই জুলাই পর্যন্ত সব কিছু পূর্বপরিকল্পনার অংশ ছিল। সাবেক আন্দোলন সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম এক টিভি আলোচনায় বলেন, মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ হত্যা না ঘটালে আন্দোলন সফল হতো না। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও বলেন, আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে সশস্ত্র সংঘাতে যাওয়ার প্রস্তুতি ছিল। এসব অস্ত্রের উৎস খুঁজে বের করা কি বিবিসির দায়িত্ব নয়?
এমনকি, অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও যানবাহনও হামলার শিকার হয়। কিন্তু তারা কি কাউকে গুলি করেছে? অনেক স্থানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে, যেন আগুন নেভাতে না পারে। এভাবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার জালকুড়ি এলাকায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের পার্শ্ববর্তী ‘শীতল ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের’ বাস ডিপোতে থাকা ২৪টি বাস পুড়িয়ে ছাই করে দেয় আন্দোলনকারীরা।
এর কারণ, বাস কোম্পানিটির চেয়ারম্যান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান। আন্দোলনকারীরা এটা জেনেই ডিপোটিকে টার্গেটে করে আগুন দিয়েছে বলে জানান পরিচালক ফারুক হোসেন। এমনকি কাউকে আগুন নেভাতে দেয়নি হামলাকারীরা। ফায়ার সার্ভিস পৌঁছানোর পর তাদেরও আটকে দেওয়া হয়। সব ক’টি বাস নির্বিঘ্নে পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে। এসব তথ্য বিবিসির প্রতিবেদনে অনুপস্থিত।
বিবিসির প্রতিবেদনটির কেন্দ্রবিন্দু একটি ফোনালাপ, যাতে শেখ হাসিনা নাকি “প্রাণঘাতী অস্ত্র” ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন।
বলা হয়, ১৮ই জুলাই এই কলটি করা হয়। কিন্তু ফোন রেকর্ডটির উৎসের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেওয়া হয়নি। দাবি করা হয়, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ক্লিপটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। অথচ ৫ই আগস্টের পর গোটা গোয়েন্দা কাঠামোতেই বড় রদবদল হয়। পুরনোদের অপসারণ, বরখাস্ত বা বদলি করে নতুন পদায়ন করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই পূর্বে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে শাস্তিপ্রাপ্ত ছিলেন। এমনকি অনেক বছর আগে অবসর নেওয়া কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে এনেও উচ্চপদে পদায়ন করা হয়েছে।
তাহলে বিবিসি কীভাবে এই সংস্থাগুলোর সরবরাহকৃত অডিও টেপ-এর ওপর এতটা আস্থাশীল হলো? এটা নিঃসন্দেহে প্রতিবেদনটির নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কথিত ফোনালাপে কাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাও স্পষ্ট নয়। যদি এটি বাস্তব ফোনালাপ হয়, তাহলে সম্পূর্ণ রেকর্ড থাকা উচিত। আংশিক রেকর্ডের পেছনে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
“ইয়ারশট” নামের একটি প্রতিষ্ঠান বলেছে, এটি “এডিটেড হওয়ার সম্ভাবনা কম।” কিন্তু তারা এটি অসম্ভব নয় বলেও জানিয়েছেন। বর্তমান ডিপফেইক প্রযুক্তিতে কারো কণ্ঠস্বর ও পটভূমি তৈরি করে মিথ্যা অডিও তৈরি কঠিন কিছু নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গতকালই দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)-এর বরাতে জানিয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কণ্ঠ নকল করে গত ১১ মাসে একটি চক্র ২৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দলের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে। যারা বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত, খালেদা জিয়ার কণ্ঠস্বর নিয়ে তাদেরই সন্দেহ জাগেনি, এতটাই নিখুঁত ছিল প্রযুক্তি! এতে স্পষ্ট, যে কারো কণ্ঠস্বর নকল করে ফোনালাপ তৈরি এখন আর কঠিন কিছু নয়।
গত ১৯শে জুলাই নরসিংদী কারাগারে হামলা চালিয়ে ৮২৬ বন্দিকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়, যাদের মধ্যে ৯ জন চিহ্নিত জঙ্গিও ছিলেন। এরপর ৫ই আগস্ট পর্যন্ত তারা কোথায় গেল, কী করল, এসব প্রশ্নের উত্তর বিবিসির প্রতিবেদনে অনুপস্থিত।
দৈনিক প্রথম আলোতে গত বছরের ১৯শে জুলাই প্রকাশিত ‘নারায়ণগঞ্জে পাসপোর্ট অফিসে আগুন, নেভাতে এসে পুড়ল ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি‘ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ১৯শে জুলাই শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সেখানে আগুন জ্বলেছে।
পাসপোর্ট অফিসের পাশে জেলার পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) অফিসে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় সেখানে বাস, প্রাইভেট কার, পিকআপ, মোটরসাইকেলসহ ১২টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। আগুন নেভাতে এলে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়িও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
সেসময় প্রকাশিত আরও অনেক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের পাসপোর্ট অফিস থেকে বিপুল সংখ্যক পাসপোর্ট বই লুট করে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। জুলাই-আগস্টে কারাগার ভেঙে বেরিয়ে আসা দুর্ধর্ষ জঙ্গি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এই পাসপোর্টগুলো সংগ্রহ করে দেশ থেকে সরে পড়েছে কিনা, এ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
জেল পালানো বন্দীদের প্রসঙ্গে কারা অধিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পলাতক বন্দীদের খুঁজে পাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, তারা কোনোভাবে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন।
পড়ুন: শেখ হাসিনা সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল লস্কর-ই-তৈয়বা, দাবি শীর্ষ কমান্ডারের
বিবিসি বাংলাতেই দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের এক মুখপাত্র এই জুলাই আন্দোলনে তার সংগঠনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। ইমতিয়াজ সেলিম নামের হিযবুত তাহ্রীরের মিডিয়া সমন্বয়কের এই সাক্ষাৎকার বিবিসি বাংলা প্রকাশ করেছে ‘নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীর প্রকাশ্যে কাজ করছে, কী বলছে সরকার?’ শিরোনামে গত বছরের ১৩ই সেপ্টেম্বর।
শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষ কমান্ডার মুজাম্মিল হাশমি সরাসরি এই আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে বক্তব্য দিয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, তারা একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটিয়েছে বাংলাদেশে। বিবিসি কি এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তদন্ত করবে?
একটি প্রশ্ন বিবিসির উদ্দেশ্যে
যদি কোনো দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়—জেলভাঙা, জঙ্গি ছাড়া, অস্ত্র লুট, সরকারি ভবনে হামলা, পুলিশ হত্যা—তবে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী কী ধরনের নির্দেশনা দেবেন? আমরা জানতে চাই, বিবিসি’র মতে এমন পরিস্থিতিতে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর কেমন ভূমিকা নেওয়া উচিত?
সংক্ষেপে, বিবিসির প্রতিবেদনটি এমন একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে যেখানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, পুলিশ সদস্যদের মৃত্যু ও অরাজকতার বিস্তার একেবারেই উপেক্ষিত। প্রকৃত তদন্ত ও সাংবাদিকতার দাবি হলো—উভয় দিক থেকেই সত্যকে তুলে ধরা। পক্ষপাতদুষ্ট এই প্রতিবেদন সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ।